আরবিসি ডেস্ক : আজ সেই ভয়াল ও বিভৎস্য কালরাত্রির স্মৃতিবাহী ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের ৫০ বছর পূর্তির দিন। বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘটানো গণহত্যাকা-ের দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৭ বছর পর ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব পাস হয়।
দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে কয়েকটি কর্মসূচী পালিত হবে। গণহত্যার ৫০ বছরপূর্তিতে আজ বৃহস্পতিবার এক মিনিটের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে গোটা দেশ। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সরকারী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজ গণহত্যা দিবসে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে সব আলো নিভিয়ে সারাদেশের মানুষ এক মিনিটের প্রতীকী ব্লাকআউট কর্মসূচী পালন করবে। তাই ২৫ মার্চ রাতে সকল সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী ভবন ও স্থাপনাসমূহে কোন আলোকসজ্জা করা যাবে না। তবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কলোরাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
মাত্র এক রাতে এমন নির্বিচারে গণহত্যার ঘটনা বিশ্বে নজীরবিহীন। তাই ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে সরকার থেকে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে কেন গণহত্যা দিবস পালন করা উচিত, এর পেছনে সমস্ত তথ্য উপাত্ত, যুক্তি উপস্থাপনে ডকুমেন্টস তৈরি করে পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতির সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
২৫ মার্চ সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছিল। এক সময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধুম্রকু-লী ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। উত্তাল দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালীর জীবনে। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। হতচকিত বাঙালী কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ভূখ-ে হিটলারের গেষ্টাপো বাহিনীর কায়দায় রাতের অন্ধকারে পাক জল্লাদ বাহিনী এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই মৃত্যু তার রেখে গেছে করাল স্বাক্ষর। মানুষের কান্না ভারি হয়ে এলো শহরের আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান শিখা। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর।
একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালী জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের বিভীষিকাময় ভয়াল ও নৃশংসতম বর্বরতা। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনক্সা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে উঠেছিল নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালী নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেকস্থানেই মাত্র এক রাতেই পাকিস্তানী হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালীকে।
অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানী সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। একাত্তরের এ দিনে চির আকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার সোঁদা মাটি। ঘুমন্ত শিশু, বধূ, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হয়েছিল মানব ইতিহাস। সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান- হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়।
এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার, যা ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই। স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকসেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ।
শুধু নিষ্ঠুর ও বিভৎস্য হত্যাকা-ই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তহাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের (বর্তমান কন্টিনেন্টাল হোটেল) সামনে সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদাররা। এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও।
একাত্তরে যেসব এ দেশীয় রাজাকার-আলবদর-আল শামস ওই রাতে গণহত্যা চালাতে পাকহানাদারদের সহযোগিতা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল, লুটপাট-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল- সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বেশিরভাগ শিরোমনিকেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। কার্যকর হয়েছে মৃত্যুদ-ের রায়। বেশ ক’জন যুদ্ধাপরাধী কারাগারের ফাঁসির কাষ্টে মৃত্যুর প্রহর গুণছে।
আরবিসি/২৫ মার্চ/ রোজি