• বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৪ অপরাহ্ন

আজ পতাকা দিবস : স্মৃততিে অগ্নঝিরা র্মাচ

Reporter Name / ১২৫ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১

আরবিসি ডেস্ক : ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ দিবাগত রাত তখন ১২ টার কিছুটা বেশি হবে। অর্থাৎ ২রা মার্চ কারণ কিছুক্ষণ আগেই দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামে ঢং ঢং ঢং করে ১২ টা বাজার সংকেত দিয়েছে।

কিছুদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা, টেবিলে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ দরজায় টোকা, ‘মুহিত বাসায় আছ’। আমি দরজা খুলে দিলাম। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন টাঙ্গাইলের খ্যাতিমান ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ। তাকে বসতে দিয়ে বড় ভাইকে ডেকে দিলাম। তারা প্রায় ২ ঘন্টা কথা বললেন। চা-নাস্তা খেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। পরের দিন বুঝতে পেরেছিলাম শাহজাহান সিরাজের তাড়াহুড়োর কারণ।

১ মার্চ সন্ধ্যায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তার ভাষণে যখন তিনি ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন, তখনই বারুদে আগুন লাগে। সারা বাংলাদেশ যেন সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এল ‘মানি না, মানি না’ উচ্চারণে। মিছিলে মিছিলে রচিত হতে লাগল একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের ইতিহাস।

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা তখন শেখ মুজিবুর রহমান। সত্তরের নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্র ও প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বললে শেখ মুজিবুর রহমানকেই বোঝায়। কিন্তু ইয়াহিয়া আর জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের নেতার হাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনভার তুলে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন। আর সেই উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই এক এক করে বিদায় নিচ্ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের চিহ্নগুলো ।

১৯৭১ সালের ১ মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের পর থেকেই ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। ২ মার্চ ঢাকা ছিলো হরতালের নগরী, মিছিলের নগরী এবং কারফিউর নগরী। দিনের হাইলাইট ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ. স. ম আবদুর রব। সঙ্গে ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। বিশাল এই সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। সভার শুরুতে সমবেত ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করে। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন। সভায় তোফায়েল আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররম যায়। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা ওড়ানো হয়।

সেদিন সকাল থেকেই মিছিল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়মুখী। স্মরণকালে এমন ছাত্র সমাবেশ দেখেনি কেউ! নিউমার্কেটের মোড় থেকে নীলক্ষেতের সড়ক দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, এ মিছিলে ছিলেন সব শ্রেণির জনগণ।

এদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মন থেকে পাকিস্তান নামটা মুছে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সন্ধ্যায় তার প্রেস কনফারেন্সে বারবার বাংলাদেশ উচ্চারণ করেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ পল্টন ময়দানে সমাবেশ করেন, যাতে বক্তৃতা দেন সাইফুদ্দিন মানিক, মতিয়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলামসহ অনেকে।

ঢাকা শহরে ছিলো হরতাল। স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা সবগুলো ছিলো জনশূন্য, কোনো অফিসে কাজ হয়নি। লোকসমাগম বলতে রাস্তায় এবং প্রতিবাদ সমাবেশে। সারাদিন একটি ট্রাকে করে আওয়ামী লীগের সদস্যরা সবাইকে শান্তি বজায় রাখার আহবান জানান। বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় এটাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ।

সারা শহরে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। পঞ্চাশ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের বেশিরভাগই তেজগাঁও এলাকার। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র্ আজিজ মোর্শেদ ও মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর আজিজ মারা যান।

সামরিক আইন প্রশাসকের তরফে এদিন কারফিউ জারি করা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত এই কারফিউ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ মুজিবুর রহমান নিরস্ত্রদের উপর গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানান। পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা) হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পল্টনে এক সমাবেশের ঘোষণা দেন তিনি।

রাতে হঠাৎ বেতার মারফত ঢাকা শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা করা হয়। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকেরা কারফিউ’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান তুলে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে স্লোগান ছিল- ‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি। পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড রচনা করা হয়। ডি. আই. টি এভিনিউর মোড়, মর্নিং-নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে নয়টায় সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। বিরাট এক জনতার মিছিল কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চলে। এভাবেই উত্তাল আর উন্মত্ত হয়ে উঠে মার্চ মাসটি।

# লেখক তৎকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন এবং ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

আরবিসি/০২ মার্চ/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category