রাবি প্রতিনিধি : জীবন মানে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়, আবার কেউ ধৈর্য্য হারিয়ে খুব সহজেই হেরে যায়। অনেকে আবার এ জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যায় জয়ী না হওয়া পর্যন্ত। যারা যুদ্ধটা অবিরাম চালিয়ে যায় তারাই মূলত হার না মানা সৈনিক।
তেমনই একজন জীবন যুদ্ধে হার না মানা সৈনিকের নাম রাজিয়া সুলতানা রুমকি। পড়াশোনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। রুমকির বাড়ি রাজশাহী নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায়। বাবা হাফিজুর রহমান একজন পিকআপ ভ্যানচালক। মা নাজনীন বেগম গৃহিণী।
পরিবারে দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট রুমকি। জন্মগতভাবেই স্বাভাবিকের চেয়ে দুই পা ছোট তার। চলাফেরা করতে হয় হয় হুইল চেয়ারে কিংবা মায়ের কোলে চড়ে। তাতে কী, মনের দিক দিয়ে অদম্য রুমকি। আর মেধাতেও অনন্য বলেই জায়গা করে নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রুমকির শিক্ষাজীবনের শুরুর গল্পটা শোনা গেলো তাঁর মায়ের মুখে। মা নাজনীন বেগম বলেন, ‘রুমকিকে ছোটবেলায় লিখতে দিতাম মেঝেতে। চক দিয়ে সে মেঝেতে লিখত। স্কুলে ভর্তি করানোর মতো তেমন উপায় না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সে স্কুলেই যায় নি। এসময় পাশের স্কুল থেকে বই সংগ্রহ করে তাকে পড়াতাম। স্কুলগুলোতে পরীক্ষা হলে প্রশ্নপত্রগুলো জোগাড় করে নিয়ে এসে বাসায় রুমকির পরীক্ষা নিতাম। পাশাপাশি একজন গৃহশিক্ষক তাকে প্রাইভেট পড়াতেন।’
কিন্তু সমস্যাটা বাঁধলো এর পড়েই। রুমকি তখন চেয়ে বসলো সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে। ভর্তির জন্য লাগবে পঞ্চম শ্রেণি থেকে উত্তীণের্র সার্টিফিকেট। কিন্তু রুমকি তো তখনও স্কুলের বারান্দায় না গিয়ে নিজ বাসাতেই পড়াশোনা শিখেছেন। একদিকে রুমকির শারীরিক সমস্যা অন্যদিকে নেই সার্টিফিকেট! মা নাজনীন বেগম অনেক যোগাযোগের পরও যখন কোনো উপায় না পেয়ে রুমকিকে বুঝিয়ে বললেন ‘তোমার পক্ষে হয়তো পড়াশোনা করা আর হবে না।’ রুমকিও তখন কিছুটা হতাশ হলেন। প্রায় দুইবছরের জন্য থেমে গেলো রুমকির পড়াশোনা।
এর পরের গল্পটা শোনা হয় রুমকির নিজের মুখেই। রুমকি জানান, প্রায় দুইবছর রুমে শুয়ে বসে সময় কাটতো তাঁর। দুইবছর পড়াশোনার বাইরে থাকায় নিজের নাম লিখতেও ভুলতে বসেছিল রুমকি। এসময় গণমাধ্যমে রুমকি দেখে তাঁর চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও অনেকে পড়াশোনা করছে। এসব দেখে অনুপ্রণিত হয় রুমকি।
আবারও মায়ের কাছে বায়না ধরে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। এবার বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি নেয়া হয় তাকে। তবে শর্ত দেয়া হয় পরবর্তী শ্রেণিতে তাকে রোল এগিয়ে আনতে হবে। শর্ত মেনে নিয়ে মায়ের কোলে চড়ে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করে সে। পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে স্কুলের দেয়া শর্ত পূরণ করেও ফেলে রুমকি। ১৫৩ থেকে পরবর্তী শ্রেণিতে তাঁর রোল হয় ২০। এরপরে আর পিছুটান কাজ করেনি রুমকির মনে। স্কুলের সহপাঠী এবং শিক্ষকরাও তাকে টেনে নেয় কাছে।
পরবর্তীতে সে জেএসসি’তে জিপিএ ৪.৫০ এবং ২০১৬ সালে এসএসসি’তে জিপিএ ৪.২৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এর পরে ভর্তি হয় রাজশাহী মহিলা কলেজে। সেখানেও এইচএসসি’তে জিপিএ ৪.০৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় রুমকি।
রুমকির পরের স্বপ্ন আলাদা। রুমকির মা নাজনীন বেগম যদিও বলতেন- মহিলা কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার কথা। কিন্তু রুমকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তাই বাসায় ইংরেজি প্রাইভেট পড়ার পাশাপাশি মায়ের সহযোগিতায় সাধারণ জ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে রুমকি। চলে আসলো ভর্তি পরীক্ষা। অনিশ্চয়তার মাঝে পরীক্ষা দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় উর্দু বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায় রুমকি।
কিন্তু উর্দু বিভাগের পাঠদান হয় শহীদুল্লাহ্ কলা ভবনের তিন তলায়, এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেন রুমকি। পরে আরবি বিভাগে পড়ার সুযোগ মেলে। কিন্তু আরবি বিভাগের কার্যক্রমও চলে একই ভবনের তিন তলায়। ফলে রুমকিকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠানো ছিলো তাঁর চল্লিশোর্ধ্ব মায়ের পক্ষে কষ্টকর। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর কলা অনুষদের নিচতলার অন্য বিভাগে পড়াশোনার জন্য আবেদন করলে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে বাংলা বিভাগে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া হয়। এখনও সেই বিভাগেই পড়াশোনা চলছে রুমকির।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেড়ে ওঠা রুমকি এখন স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষক হওয়ার। কেনো শিক্ষক হতে চান? এমন প্রশ্নের জবাবে রুমকি বলেন, ‘শিক্ষকতা আমার কাছে মহান পেশা। শিক্ষকরা আমাকে সব জায়গায় কাছে টেনে নিয়েছেন। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আমার জন্য। আমিও চাই এমন কিছু করতে। আমার মতো অন্যদের কাছে টেনে নিতে।’
সার্বিক বিষয়ে রুমকি বলেন, রাবি থেকে আমার পাওয়ার শেষ নেই। আমার বিভাগ, রাবি প্রশাসন সব সময়ের জন্য আমার পাশে থাকেন। তবে রাবিতে পড়ুয়া আমার মতো অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে একটি চাওয়া থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেনো আমাদের ব্যবহারের জন্য ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করেন। কারন সেসব ওয়াশরুম আমাদের জন্য উপযোগী না। আর একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত ওয়াশরুমে না যাওয়া অনেক কষ্টকর। এজন্য প্রায়ই ক্লাস বাদ দিয়ে আমাকে বাসায় ফিরতে হয়।
রুমকির পরিবার সূত্রে জানা যায়, রুমকির বাবার পিকআপ ভ্যানটি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তেমন ভাড়া পাচ্ছে না নিয়মিত। ফলে বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। রুমকি সিজেডএম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য কোন বৃত্তি পান না।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, রুমকির পাশে আমরা সবসময়ের জন্য আছি। রুমকি যদি তাঁর সমস্যার কথা জানিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত কোনো আবেদন জানায়, তাহলে অবশ্যই আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নেবো।
আর বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বললেন, ওয়াশরুমের বিষয়টি নিয়ে এরআগে সেরকমভাবে ভেবে দেখিনি। এ ব্যাপারে আমি শীঘ্রই প্রধান প্রকৌশলী এবং রুমকির মতো অন্যদের সাথে কথা বলবো। আশা করি ক্যাম্পাস খোলার পূর্বেই ওয়াশরুমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আরবিসি/০২ মার্চ/ রোজি