স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীর নগরীর কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় থেকে বাইরে বেরোনোর উদ্দেশ্যে ধাপ বাড়ালেই পা পড়বে মূল সড়কে। চারতলা ভবন ছাড়া বিদ্যালয়ের বাড়তি কোন জায়গা নেই। নেই খেলার মাঠও। স্বভাবতই শহিদ মিনার থাকার প্রশ্ন সেখানে এড়িয়ে যেতে হয়।
কথা হয় ১১ বছর বয়সী সাদমান আহমেদ সিয়ামের সাথে। সে গত বছর এই বিদ্যালয় থেকে অটোপাশের ভিত্তিতে প্রাথমিক সমাপনি সম্পন্ন করেছে। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ক্লাস করা হয়ে ওঠেনি।
সিয়াম জানায়, ওই বিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিভিন্ন দিবসে শহিদদের স্মৃতির উদ্দ্যেশে শ্রদ্ধা জানাতে তাদেরকে যেতে হয় বাইরের কোন প্রতিষ্ঠানে। সেখানে গিয়েই ফুল দেয় তারা। এজন্য শহিদ মিনারের সঙ্গে তার পরিচয় ছিলনা। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দিবসে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শিক্ষকরা তাদেরকে শহিদ মিনার আঁকানো শিখিয়েছেন। ফলে সিয়াম শহিদ মিনারের ছবি আঁকানো শিখলেও দেখেছে অনেক পরে।
একই কথা জানায় সিয়ামের সহপাঠী তামান্না তারা। তার দাবি, সেও শহিদ মিনার স্বচক্ষে দেখার পূর্বেই আঁকানো শিখেছে। পরে দেখেছে শহিদ মিনার। এই দু’জন ক্ষুদে শিক্ষার্থী জানায়, তাদের বিদ্যালয় শহিদ মিনার থাকলে তারা সহজেই শহিদ মিনারের ছবি আঁকতে পারতো।
শুধুমাত্র এই বিদ্যালয় নয়, নগরীর রেলওয়ে স্টেশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হেলেনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ মিশন একাডেমীর শিরোইল বালিকা শাখা-সহ বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোতে যেমন পর্যাপ্ত জায়গা, খেলার মাঠ নেই, তেমনিভাবে নেই শহিদ মিনারও। ফলে গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনারে যান শিক্ষকরা। আবার কখনো শোলা দিয়ে তৈরি অস্থায়ী শহিদ মিনারেই করা হয় শ্রদ্ধা নিবেদন।
এর ফলে শহিদ মিনার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা যেমন অস্পষ্ট; তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না শিশুরা।
কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাহমুদা খাতুন বলেন, আমরা বিভিন্ন দিবসগুলো গুরুত্বের সাথে পালন করি। যেহেতু মাঠ নেই তাই শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনারে বাচ্চাদের নিয়ে যাই। এছাড়াও অনেক সময় শোলা দিয়ে নিজেরাই অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৫৭টি। এর মধ্যে শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ৪৪৬টি বিদ্যালয়ে। সেটাও বেড়েছে বিগত কয়েক মাসে। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও মাত্র ২৩১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার ছিল। তারপরেও বর্তমানে শহিদ মিনার নেই জেলায় এমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬১১টি।
জানা গেছে, জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪০টি, চারঘাটে ৭৩টির মধ্যে ১২টি, তানোরে ১২৮টির মধ্যে ১০১টি, দুর্গাপুরে ৮৩টির মধ্যে ৭৮টি, পুঠিয়ায় ৯০টির মধ্যে ৯টি, বাগমারায় ২২০টির মধ্যে ১১টি, বাঘায় ৭৪টির মধ্যে ৭টি, মোহনপুরে ৮১টির মধ্যে ৩টি ও বোয়ালিয়ার অন্তর্ভূক্ত ৬০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাত্র ৩টিতে শহিদ মিনার রয়েছে।
জেলার একমাত্র উপজেলা হিসেবে পবায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। এই উপজেলার ৮৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে শহিদ মিনার রয়েছে। এছাড়াও তানোর উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার থাকায় ২৬টি বিদ্যালয়ে আলাদাভাবে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহিদ মিনার নির্মাণে সরকারি কোন বরাদ্দ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উপজেলা শিক্ষা অফিস উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলের সহযোগিতায় শহিদ মিনার নির্মাণ করে থাকে। তাই শতভাগ বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এর বাইরেও নগরীর বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা নেই, সেই কারনে এগুলোতে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালাম বলেন, শহিদ মিনার নির্মাণে সরকারি কোন বরাদ্দ নেই। ফলে থানা শিক্ষা অফিস ও বিদ্যালয়গুলো স্ব-উদ্যোগেই শহিদ মিনার নির্মাণ করে থাকে। আমরা শুধু নির্দেশনা দিই।
তিনি আরও বলেন, যেগুলো বিদ্যালয়ে জায়গা সঙ্কট সেগুলোতে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব না। আর যেসকল বিদ্যালয়ের পাশেই হাইস্কুল, কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনার আছে, সেগুলোতে শহিদ মিনার নির্মাণের প্রয়োজন নেই, শিক্ষার্থীরা পাশ^বর্তী শহিদ মিনারেই দিবসগুলো পালন করবে, সেরকমই নির্দেশনা রয়েছে। আর যেগুলো প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব, সেগুলোতে নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
আরবিসি/২১ ফেব্রুয়ারি/ রোজি