মুস্তাফিজুর রহমান খান (আলম) : বায়ান্নর একুশ ছিল রক্তাক্ত। ঢাকার রাজপথের কালো পীচ লাল করা একুশ। দামাল ছেলেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রক্ষা করেছিল মাতৃভাষা বাংলা। সেই থেকে একুশ আমাদের কাছে সংগ্রামের প্রতীক। অর্জনের লাল সূর্য। শুধুই সামনে এগিয়ে চলার অমিও তেজ আর দৃপ্ত পদভারে ধরনী প্রকল্পিত করার দুঃসাহস।
তারপর পাকিস্তানী দুঃশাসন, স্বৈরাচারী স্টীম রোলার, পুলিশি নির্যাতন, ১৪৪ ধারা, কারফিউ উপেক্ষা করে প্রতি বছরই পালিত হয়েছে ২১ শে ফেব্রয়ারি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’’। উষালগ্নে খালি পায়ে আবাল বৃদ্ধ বনিতার প্রভাত ফেরী আর আবেগ জড়িত কন্ঠে গীত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো…। ” শহীদ মিনারে মিনারে পুষ্পাঞ্জলি। বুকে বুকে শোভা পেত শোকের প্রতীক, সাংগামের দৃপ্ত অঙ্গীকার “কালো ব্যাজ”।
তখন ছিল অস্থায়ী সব শহীদ মিনার। পাকিস্তানী পুলিশের কাজ ছিল পরের দিনই সে সব শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত সব শহীদ মিনার কেবলই দৃঢ় ভিত্তি লাভ করছিল। গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল। ভয়ভীতি তুচ্ছ করে একুশের উষালগ্নে মিছিল আর মিছিলে প্রকম্পিত করছিল গ্রামগঞ্জের পায়ে হাঁটা পথ থেকে শহরের পাকা রাস্তা আর রাজধানীর পীচ মোড়া রাজপথ পর্যন্ত। সূর্য রক্তিম বর্ণ ধারণ করার আগেই শোনা যেত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।” এখন মধ্যরাতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পিড়াপিড়ী। অথচ বাঙালি বাংলার সব কিছুই শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
রাজধানীতে ১৯৬৯ সালের একুশ আসে অন্য পটভূীমতে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহা-নুরুল ইসলাম শহীদ হওয়ার পর সেদিন দুপুর থেকে কারফিউ জারী করেছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। সকালের দিকে কয়েকঘন্টা কারফিউ শিথিল করার পর সন্ধ্যা নামার আগেই কারফিউ। ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি সেভাবেই বন্দী জীবন পার করেছিল রাজশাহীবাসী। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি শেষরাত্রি শেষে ভোর চারটায় কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়। তারপরই তড়িৎ গতিতে একুশ পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়। সেই শেষ রাতেই সাহেব বাজারের কাপড় পট্টির কয়েকটা দোকান খোলা পাওয়া যায়। ভুবন মোহন পার্কের দক্ষিণে সরু পথে দিয়ে ঢুকেই এক দোকানদার আমাদের একখান কালো কাপড় দেয়। মূহুর্তে কেটে কেটে হাজার হাজার কালো ব্যাজ হয়ে যায়।
সেই ব্যাজ বুকে লাগিয়ে মিছিল চলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ড. জোহার সমাদ্ধির দিকে। তখনের সংকীর্ণ পথ ধরে মিছিল চলেছিল পূর্বপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। আর মিছিল ফিরছিল বাধের উপর দিয়ে। কোথায় কোন ছেদ ছিল না। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যেন জনসমুদ্র। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আর বাধের উপর দিয়ে ফিরছে। সে এক বিজয় মিছিল। রাস্তায় কোন পাকিস্তানী পুলিশ, পাকিস্তানী মিলিটারী দেখা যায়নি। কিন্তু আশংকা ছিল বোধ হয় একুশ পালন হবে না।
১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর একুশ পালন হয়েছিল প্রায় বন্ধী অবস্থায়। ১৪৪ কারফিউ উপেক্ষা করে ১৯৭১ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্মূল করার ব্যর্থ চেষ্টা শুরু হয় ২৫ মার্চ মধ্য রাত্রি থেকে। বাংলাদেশের সব শহীদ মিনার ধ্বংস করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জনযুদ্ধ। জনগণের যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র হয়ে উঠে। লাঙ্গল-কোদাল-কুড়াল, কাস্তে-হাতুড়ী-বাটালী, কলম-পেন্সিল ফেলে ধরেছিল। লাঠি-বল্লম-বর্ষা। তারপর হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তর ৭ই মার্চ এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণের পরই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। সশস্ত্র বাঙালি। সে জন্য ন’মাসেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল আর এক একুশ আসার আগেই। তাই পাকিস্তানী সামরিক জান্তা একুশকে বন্দী করতে পারেনি। ১৯৭২ এর একুশ পালন করেছিল বিজয়ী জাতি মুক্ত স্বদেশে। বেদনা বিধুর পরিবেশে বিজয় মান্য গলায় ধারণ করে গেয়েছিল “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি…।”
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক, আইনজীবী
আরবিসি/২০ ফেব্রুয়ারি/ রোজি