রাবি প্রতিনিধি : মধ্যদুপুর। সূর্য্য ঠিক তখন মাথার উপরে। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনের পশ্চিম পাশের দেয়ালে রঙ-তুলি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। কেউ প্লাস্টিকের পাত্রে রং তৈরি করছেন। আবার কেউ সেই রং দিয়ে সাদা দেয়াল রাঙিয়ে তুলছেন। সামনের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে অঙ্কন করা হচ্ছে এই দেয়ালচিত্রটি। রং-তুলির আঁচড়ে দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠছে বাংলাদেশের ইতিহাস।
দেয়ালটির গায়ে ছোঁয়া লাগছে হরেক রকমের রঙ-তুলির। লাল, নীল, সবুজ, হলুদসহ নানা রঙের তুলিতে তৈরি হচ্ছে দেয়ালচিত্র, রঙিন হচ্ছে ক্যানভাস।
বিশাল এই দেয়ালচিত্রটি দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী। যা মনে করিয়ে দিচ্ছে দেশভাগ থেকে শুরু করে ৫২-র ভাষা আন্দোলনসহ ৬৬-র ছয় দফা, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বের এবং পরবর্তী মুহুর্তগুলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিমূর্ত ধারার বিশাল এই চিত্রকর্মটি তৈরিতে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শামীমা আক্তার বন্যা, প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী, রায়হান আহমেদ, সুভাষ পাল এবং সৌমিত্র কুমার। আর তাতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক। চিত্রকর্মটিতে বামপাশে শুরুর দিকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের সময়কালের সেই ভয়াবহতা। পরবর্তীতে শহীদ মিনারের চিত্র। মাঝ বরাবর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের বর্বরতার দৃশ্য, এরপরেই বাঙালির কাঙ্খিত বিজয় অর্জনের প্রতিচ্ছবি। আর সবশেষে ডানপাশে বই বুকে স্কুলে যাওয়া শিশুদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আবহমান দৃশ্যাবলি।
সকাল ৮টা থেকে দেয়ালচিত্র অঙ্কন করছেন চারুশিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী। তিনি জানান, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা এই দেয়ালচিত্র অঙ্কনের কাজটি শুরু করেছেন। হাতে বেশি সময় না থাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৮ পর্যন্ত লাইট জ্বালিয়ে কাজ করছেন তারা। দেয়ালচিত্রটি অঙ্কন করতে বেশ ভালোই লাগছে বলে জানান তিনি।
বিশাল এই দেয়ালচিত্রটির খসড়া তৈরী করেছেন চারু শিক্ষার্থী শামীমা আকতার বন্যা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেয়ালচিত্রটির লে-আউট বানাতে প্রায় পাঁচদিনের মতো সময় লেগেছে। চিত্রকর্মটিতে দেশ ভাগের পূর্ব থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আর কাজটি করে অনেক ভালো লাগছে। কারণ আমরা চারু শিক্ষার্থীরা কাজের মধ্যে থাকলেই নতুন কিছু শিখতে পারি। নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারি।’
চিত্রকর্মটির বিষয়ে জানতে চাইলে মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক বলেন, ‘মানুষ বিভিন্নভাবে ভাব প্রকাশ করে, কেউ গান গেয়ে, কেউ অভিনয় করে আবার কেউ ছবি এঁকে। এই দেওয়ালচিত্রটি অনুধাবন করলে দেখা যাবে, যেই ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালিদের বুকের তাজা রক্ত ঝরেছিল। সেই ভাষায় রচিত বই এখন আমরা বুকে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই। বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাসকে এই দেওয়ালচিত্রটিতে ধাপে ধাপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চিত্রটির বামপাশ থেকে যদি দর্শনার্থীরা দেখা শুরু করেন তাহলে ডান পাশে যেতে যেতে চিত্রকর্মটির প্রেক্ষাপট জেনে ফেলবেন। চিত্রকর্মটিই দর্শনার্থীকে বলে দিবে সে কিসের বার্তা বহন করছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশাল এই দেয়ালচিত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার অধীনে অঙ্কন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আনন্দ বলেন, সামনের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এই দেয়ালচিত্রটি অঙ্কন করা হচ্ছে। এর আগেও এখানে একটা চিত্রকর্ম ছিলো। তবে দেওয়ালটি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে চিত্রকর্মটিও নষ্ট হয়ে গেছিলো। তাই দেওয়ালটি মেরামতের পর নতুন করে আরেকটি দেয়ালচিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিমূর্ত এই চিত্রকর্মটি দর্শানার্থীদের দেশের পূর্বের এবং বর্তমান অবস্থাকে মনে করিয়ে দেবে। দেয়ালচিত্রটি আশা করি দর্শনার্থীদের ভালো লাগবে।
আরবিসি/১৯ ফেব্রুয়ারি/ রোজি