• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৩ অপরাহ্ন

মহৎ ও অনন্য শিক্ষক শহীদ ড. শামসুজ্জোহা

Reporter Name / ১৬৮ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ড. মো. জুলকার নায়েন : আজ ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ড. জোহা দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. মোহম্মদ শামসুজ্জোহা ছাত্রদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হন। দিনটি রাজশাহী বিশবিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষক মহলের কাছে এক বেদনার দিন।

১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে যোগদান করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত ৬ দফা কর্মসূচী পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রণীত ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১-দফার দাবিতে ১৯৬৯ সালের শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ বিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এরই অংশ হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি সারাদেশে দাবী দিবস, ১৮ জানুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট ও ২০ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলরত অবস্থায় পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান নিহত হয়।

এই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু সহ উর্ব্ধতন বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিচারকাজ চলছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে জেলের ভিতর গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যার প্রতিবাদে ফুসে উঠে পূর্ববাংলার জনগণ।এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্রদের একটি প্রতিবাদী মিছিল রাজশাহী শহরে পুলিশী হামলার সম্মুখীন হয় এবং সেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়। তৎকালীন প্রক্টর ড. জোহা সেখানে ছুটে যান এবং ছাত্রদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের এক প্রতিবাদ সভায় বক্তৃতাকালে ড. জোহা নিজের জামায় লেগে থাকা রক্ত দেখিয়ে বলেন “আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এর পর কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে”।

পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজশাহী শহরের উদ্দেশ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের বাইরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা সশস্ত্র অবস্থান নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ভাষা সৈনিক ড. জোহা মুখোমুখি অবস্থানের ভয়াবহতা স্পষ্টতই বুঝতে পারলেন। এ অবস্থায় তিনি ছোটাছুটি শুরু করলেন, একবার ছাত্রদের দিকে তাদের মিছিল নিবৃত্তের জন্য, তো অন্যবার সেনাসদস্যদের দিকে তাদের ফায়ার করা থেকে বিরত রাখার জন্য। তিনি হাত উচিয়ে সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে বার বার বলছিলেন “প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, দে আর ষ্টুডেন্টস্”। ড. জোহা সহ অন্যান্য শিক্ষকদের আশ্বাসে ছাত্ররা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ফিরছিল ঠিক তখনই ঘটে ইতিহাসের এক জঘন্যতম ঘটনা। পাক সেনারা অতর্কিত গুলি শুরু করলেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে গেলেন ড. শামসুজ্জোহা, আহত হলেন দায়িত্বরত আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র।

আহত ড. জোহাকে মিলিটারি ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় মিউনিসিপ্যাল অফিসে। সেখানে তাঁকে চিকিৎসা না দিয়ে দীর্ঘসময় অবহেলায় তাঁর নিথর দেহ ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা ৪.০০ টার দিকে তাঁকে সার্জিক্যাল রুমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই এই মহান শিক্ষক শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন।
ড. জোহার মৃত্যুর খবর মূহুর্তেরমধ্যেই ছড়িয়ে পরে সারা বাংলায়। আন্দোলন পায় এক নতুন মাত্রা। উত্তাল আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২২ ফেব্রুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ড. জোহার মৃত্যুর মাত্র ৩৪ দিনের মাথায় দাম্ভিক আইয়ুব খান পরবর্তী সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ইতিহাসের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবীর রক্ত বৃথা যায়নি, তার আত্মত্যাগের মাধ্যমেই ৬ দফা, ১১ দফার গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। পরবর্তীতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙ্গালী ছিনিয়ে আনে অমর স্বাধীনতা।

এই মহান শিক্ষকের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নামকরন করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল এবং ১৯৬৯ সালে ২২ অক্টোবর ড. জোহার পিতা মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ কর্তৃক হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এই মহান মানুষটির মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরষ্কারে ভূষিত করা হয় এবং তাঁর নামে একটি স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারী ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বহু বছর ধরে, এই দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবী জানিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ দাবী পূরণ হয়নি আজও।

২০২১ বাঙ্গালী জাতির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। আমরা পালন করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, স্বাধীনতার রূপকার,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী। এই বছরই পালিত হবে আমাদের গৌরাবান্বিত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। জাতির জন্য আত্মদানকারী মহান শিক্ষকের শহীদ হওয়ার দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্মরণ করার নিমিত্তে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে জাতি ও প্রজন্মকে এই মহান মানুষটিকে জানার সুযোগ তৈরী করা হোক। আমি বিশ্বাস করি ১৮ ফেব্রুয়ারি কোন এক দিন ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাবেই পালিত হবে। তবে তা হোক মুজিববর্ষে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক সরকারের হাত ধরে। লেখক-প্রাধ্যক্ষ, শহীদ শামসুজ্জোহা হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়।

আরবিসি/১৮ ফেব্রুয়ারি/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category