বিশেষ প্রতিবেদক : বুকের গভীর থেকে আজ বলুন, ভালবাসি। কারণ আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন্স ডে।
আজ শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার দিন। ভালবাসার মহাঅনুভূতির কাছে নিজেকে নিশ্চিন্তে সপে দেয়ার দিন। গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি বহু বছর ধরে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। আজও ভালবাসার শক্তিতে সুন্দর সমাজ প্রেমময় পৃথিবী গড়ার শপথে দিবসটি উদ্যাপন করবে বাঙালী। বিশেষ করে তরুণ তরুণীদের কাছে দিবসটি স্বতন্ত্র আবেদনের। আবেগের।
কবিগুরু বলেছিলেন, তোমার গোপন কথাটি, সখী রেখো না মনে।/শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে…। হৃদয়ের একান্ত গোপন কথাটি আজ প্রকাশ করবেন প্রেমিক প্রেমিকারা। প্রিয়জনের সামনে হাঁটু গেড়ে ঠিক বসে পড়বেন। বলবেন, উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন? আজ ভালবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে বাঙালী। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হবে ভ্যালেনটাইন্স ডে। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেবেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে চলবে ভালবাসার আদান-প্রদান। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় উঠবে লাল গোলাপ।
মনের গভীরের এই ভাব প্রকাশ করে হাসন রাজা গেয়েছিলেন, ‘নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে।’ ভাটি বাংলার এই লোককবির নিশা আর কাটেনি কোনদিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুর তোলেন- ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে…। এ আগুনকে দ্বিগুণ করতে আবারও এসেছে ভালবাসার বিশেষ দিবস। আজ ঘরে থাকা দায়। রাধারমণ থেকে বললে, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না…।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের। তাঁর বলাটি- আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া…। মনের মানুষটি ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালবাসার জন্য।
প্রথমদিকে দিবসটি ঘিরে কিছুটা ফিস ফিস ছিল। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ উচ্ছলতায় কাটে বিশেষ এই দিবস। ভালবাসা দিবসে নতুন করে দেখা দেয় চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে যুগল। শহর ঘুরে বেড়াবে। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে- নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলঙ্কার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না…।
অবশ্য এখন স্থূল প্রেমও কম দেখা যায় না। তরুণ-তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন। এবং বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছেন- ব্রেকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ। শুরু হয়ে যাচ্ছে নকল ভালবাসাবাসি! আবার মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেও অনেকে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রতারিত হচ্ছেন। এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার সাম্প্রতিক উদাহরণও আছে। এ অবস্থায় কী করণীয়? লোক কাহিনীনির্ভর সিনেমা রূপবানের অত্যন্ত জনপ্রিয় গান মন দিয়ে শোনা যেতে পারে, যেখানে তাজেলকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে- শুনো তাজেল গো, মন না জেনে প্রেমে মইজো না…। হ্যাঁ, মন জানা চাই। ভালবাসার আগে যাকে ভালবাসছেন তার মনটি জানতে হবে। তবেই স্বর্গসুখের হবে প্রেম। এমন প্রেম করেই তো ইতিহাস গড়েছেন লাইলী-মজনু। শিরি-ফরহাদ। ইউসুফ-জুলেখা। রোমিও-জুলিয়েট।
আজ যে ভালবাসা দিবসের কথা বলা হচ্ছে সে দিবসের সঙ্গেও মিশে আছে অমর প্রেমকাহিনী। যতদূর তথ্য এই ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবি জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরেরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা-সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না।
জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় বেশ কিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলতো তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেতো তরুণটি।
কখনও কখনও ওই দু’জনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াতো বিয়েতে। অপর গল্পটি এরকম- সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সবধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেতো।
জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিতো। হাত নেড়ে জানান দিতো, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সেদিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
আরবিসি/১৪ ফেব্রুয়ারি/ রোজি