আরবিসি ডেস্ক : নারীর ক্ষমতায়ন কথাটা জোর দিয়ে বলতে গেলে আগে প্রমাণ করতে হবে পুরুষের ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় তা হলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রবেশাধিকার। পরিবারে মতামতের প্রাধান্য ও সম্মান এই ক্ষমতায়নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিছু কিছু নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে এনে নির্যাতন বন্ধের কথাও বলা হয়, যেটা অবশ্যই যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। কিন্তু পুরুষের ক্ষমতায়ন যদি প্রমাণিত হয় ও তার অপব্যবহার যদি পুরুষেরা করে তবে নারীর ক্ষমতায়নটি অবশ্যই মানতে হবে। আর সেটি যদি প্রমাণ করা না যায় তবে নারীর ক্ষমতায়ন কথাটি বাদ দিয়ে নতুন কোনো শব্দ আনতে হবে যাতে পুরুষের অসম্মান না হয়, আবার নারী তার প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে পারে।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একজন পুরুষ কাজ করলে তার মজুরি পায়, কিন্তু একটি পরিবারে যদি কোনো নারী কাজ করে তার কোনো মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। অনেকে এই কাজগুলো কোনো শ্রমের না বলেও তাচ্ছিল্য করেন। মা তার সন্তানকে যত বড় করছেন ও সংসারের কাজগুলো করছেন তার মূল্যায়ন করতে না পারার খারাপ মানসিকতা ত্যাগ অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন বলে যে কথাটি বারবার বলা হয়, তা পরিত্যাগ করাও জরুরি। একজন পুরুষ তার একমাত্র পুরুষ পরিচয়ে কোথাও চাকরি বা কাজ পায় না। পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও পুরুষের বড় অংশ আজ বেকার। পরিবার ও সমাজে তারা অবহেলার শিকার, তাদের ওপরও চলে নানাভাবে নির্যাতন।
রাস্তাঘাটে নারীরা যেমন হেনস্তার শিকার হচ্ছে, তেমন পুরুষরাও কম হচ্ছে না। চাঁদাবাজিদের চাঁদা, ছিনতাইকারীদের ছুরির আঘাত একজন পুরুষকেও সমাজে অসহায় হিসেবে প্রমাণ করে। যেসব পরিবারে একাধিক সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানো যায়, তারা ছেলে বা মেয়ে উভয়কে পড়াশোনা করান। আবার যেসব পরিবারে একজন সদস্য মানে বাড়তি খরচ তারা মেয়েসন্তান হলে বিবাহ দেন ও ছেলেসন্তান হলে কোনো কাজে ঢুকিয়ে দেন। একজন নারী হয়তো অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু একজন পুরুষ যখন দেনমোহরের গ্যাড়াকলে পড়ে তা কতজনের মাথায় কাজ করে। তারাও হয়, কিন্তু সাধারণের সমবেদনা তারা পায় না, দেয়া হয় না।
নারী পুরুষের ক্ষমতায়ন কথাটির দ্বারা তাদের একধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা হয়। মনে হয় তারা পরস্পর শত্রু। হাজার হাজার বছর থেকে পুরুষরা শুধু নারীদের ব্যবহার করেছে। সম্মান, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা দেয়নি। সবখানে পুরুষের স্বৈরাচার চলছে, তার পতন করে নিজের হাতে ক্ষমতা নিব এমন একটি ভাব চলে আসে। নারী-পুরুষের সমতা আনতে চাই ভালো কথা, কিন্তু তাদের ভেতর শত্রুতা তৈরি করে কেন? ক্ষমতায়ন শব্দটিই তো বিভ্রান্তি তৈরি করে। নারীর সমতার জন্য তো নারীকে পুরুষের আচার-আচরণ চর্চা করার দরকার নেই, বরং নিজের যোগ্যতার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়ে যোগ্য স্থানে যাবার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। একজন পুরুষ, পুরুষ পরিচয়েই তার যোগ্য স্থানে যেতে পারে না। তাকেও তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। পুরুষ হওয়াটাই পুরুষতান্ত্রিকতার প্রমাণ নয়। এটি ব্যক্তিবিশেষে পার্থক্য করে। শুধু পুরুষ দিয়েই যেমন পৃথিবী চলবে না, শুধু নারী দিয়েও না। তাই নারীর ক্ষমতায়ন না বলে উৎপাদনমুখীকরণ বলাটাই বেশি সংগত।
নারীকে উৎপাদনমুখী করার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাহিক কাজের বাইরে এমন কিছু কাজ দিতে হবে যা উৎপাদন করায় ও তার থেকে আয় হয়। এই কাজে পুরুষের অংশ্রগ্রহণও থাকতে পারে। স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, দামি হোটেলে খাওয়া বা দামি পোশাক দেয়া নারীর ক্ষমতায়ন হতে পারে না। বরং তা নারীর জন্য ক্ষতি, সমাজের জন্য ক্ষতি। পুরুষ আয় করে যদি মদ-জুয়ায় ব্যয় করে সেটা যেমন অপচয়, তেমনি নারী আয় করে তা যদি তার প্রসাধনীতে ব্যয় করে সেটাও অপচয়। কাজ করে আয় যদি কাজে লাগানো না হয় তবে দেশের উন্নয়নে নারী-পুরুষের বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা থাকবেই থাকবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি করা বা বিলাসবহুল জীবনযাপন করা কখনোই দেশের জন্য ভালো নয়। অর্থ আয় যদি বিলাসিতা শেখায়, তবে নারীর ক্ষমতায়ন বা পুরুষের কাজ তেমন কোনো কাজে আসতে পারে না। আর এজন্য আয়কে উৎপদনমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে। নারীকে উৎপাদনমুখী করতে হবে। শহর বা গ্রামের শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যেকোনো নারীই হোক না কেন।
বাংলাদেশ মেন’স রাইটস ফাউন্ডেশন তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বিবাহিত পুরুষদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার। পুরুষ নির্যাতন দমনে কোনো আইন নেই বলে অনেকে বিষয়গুলো প্রকাশও করতে চায় না। সামাজিক হেনস্তার ভয় তো থাকেই। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আইন কমিশনের এক গবেষণায় দেখানো হয় ১০০টি নারী নির্যাতনের মামলার মধ্যে গড়ে ৯০টিতে আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে ৯০ ভাগ মামলা প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ১৫ হাজারের বেশি নারী নির্যাতনের মামলা করা হয় এবং পুলিশ তদন্তে কোনো অপরাধ খুঁজে না পাওয়ায় বা মামলা আপোষ করায় ৪ হাজার মামলা আর বিচার পর্যন্ত যেতে পারেনি। নারীর ক্ষমতায়ন যদি হয় কারো কারো কাছে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ, তবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বাস্তবসম্মত প্রক্রিয়া তৈরি করা বোকামি হবে না।
সিলেটের এমসি কলেজে যখন স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়, সেটি কি শুধু নারীর ওপর নির্যাতন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যখন মজনু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হলো সেটি কি শুধু নারীর জন্য কষ্টদায়ক। সেই মেয়ের পরিবারের বাবা, ভাই, চাচা বা মামা কোন পুরুষের অন্তরাত্মাতে আঘাত করেনি? বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক ও পরবর্তীতে যে বিবাহ না করলে ধর্ষণের মামলা, তা কি শুধু পুরুষের অবাধ ক্ষমতার ফসল। অপরাধকর্মের দায় সহজে সমাজ পুরুষের ওপর দিতে পারলেও নারীর ওপর দিতে পারে না। একজন নারী যৌতুক বা তার ওপর নির্যাতনের মামলা খুব সহজে করতে পারে, কিন্তু একজন পুরুষ দেনমোহর দ্বারা প্রতারিত হলে বা তার সাথে কোনো মেয়ে প্রতারণা করলে আইন তার প্রতিকার পাবার পথ কতটুকু খোলা রেখেছে?
দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারা বা যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮০ বা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রভৃতি আইনের বিধানগুলো শুধু কি বৈষম্য তৈরি করে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, নাকি নারীকে ক্ষমতা দিয়ে পুরুষের ওপর তথাকথিত নাম দেয়া ক্ষমতা কেড়ে নেবার অযুহাত? অপরাধ প্রমাণ হওয়পার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তের ছবি প্রকাশ না করার নিয়ম থাকলেও পুরুষের ক্ষেত্রে এই নিয়মটি খুব ঢিলাভাবে প্রয়োগ করা হয়, আর নারীর বেলায় খুব কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৪(১) ধারায় অপরাধের শিকার নারীর নাম, পরিচয় বা ছবি প্রকাশ না করার বাধ্যবাধকতা আছে এবং এটি সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া খুব ভালোভাবেই প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু পুরুষের বেলায় এমন নিয়ম আছে কি? অবস্থা দেখে মনে হয় পুরুষের সম্মান নেই, তাই সম্মানহানি হয় না, কিন্তু নারীর সম্মান আছে তাই সম্মানহানি হয়।
চাকরির অভাবে একজন ছেলে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারে না। যে প্রেমিকার যেকোনো অবস্থায় পাশে থাকার কথা ছিল, সে প্রেমিকা চাকরি না পাওয়ায় প্রেমিককে ছেড়ে চলে যায়। আর এ ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিতে হয় একজন পুরুষকে। কিন্তু একজন পুরুষ যখন এই কাজ করতে চায়, হয় তাকে ধর্ষণের মামলা না হয় অন্য কোনোভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা পরস্পরের থাকা উচিত, কিন্তু নারী ক্ষমতায়নের নাম করে তা একজনের ওপর যদি চাপিয়ে দেয়া হয় তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত হতে পারে না। পুরুষের দুঃখ উপলব্ধি করার মানবিকতা থাকা অনেক জরুরি।
ধান আর গম খাওয়া যায় বলে তাদের ভিতর সম্পর্ক আছে, কিন্তু তাদের ভিতর যে পার্থক্যগুলো আছে সেগুলো সম্বন্ধে না জানলে সমস্যা হবে। কোন মওসুমে কোন ফসল বুনতে হবে, এই জ্ঞানের অভাব উৎপাদন কমিয়ে দিবে। একজন পুরুষ যখন রিকশা-অটোরিকশা চালায়, যখন একজন পুরুষ ইট ভাঙে, তখন তা দায়িত্ব। আর একজন মেয়ে রিকশা চালালে ভাইরাল হয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তার দায়িত্ব নেয়।
পুরুষরা নারীদের শত্রু নয়। তারা বন্ধু। পুরুষের ক্ষমতায়নই যখন হয়নি, তখন মিছেমিছি নারীর ক্ষমতায়ন কথাটি বলে নারী-পুরুষের ভিতর আত্মার সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। নারী ও পুরুষকে উৎপাদনমুখী করতে হবে। একজন পুরুষ যেমন বাইরে কাজ করে আয় করে, ঘরে থেকেও একজন নারীকে আয় করতে হবে। সময়ের সাথে আয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন এসেছে। এর থেকে নারীদের আয়ের সম্ভাবনাও কম নয়। সেগুলো গুরুত্ব দিতে হবে।
নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ কথাটি না বলে ‘উৎপদনমুখীকরণ’ কথাটি ও তার আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এই উৎপদনমুখী প্রক্রিয়ায় শুধু নারীদের নিয়েই নয় পুরুষের অংশগ্রহণ নিয়ে ভাবতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ধরে রেখে সমতা আনতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রত্যয়ের পরিবর্তে নারীকে উৎপাদনমুখীকরণ কথাটি পুরুষের বেলাতেও খাটে। তাহলে ঘরের কাজ করেও যেমন উপলব্ধি ঠিক থাকবে, তেমনি ঘরের কাজ করে নারী-পুরুষ উন্নয়ন-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে সামজিক সমস্যা ও অস্থিরতা কমাতেও অবদান রাখতে পারবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
আরবিসি/০৬ ফেব্রুয়ারী/ রোজি