জয়পুরহাট প্রতিনিধি : জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বিভিন্ন মাঠে আলু ক্ষেতের গাছ ব্যাপকহারে মারা যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কৃষকরা বলছেন,বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সরবরাহ করা উন্নত জাতের আলু বীজ রোপন করে তারা প্রতারনার শিকার হয়েছেন। রোপনের প্রায় ৬০ দিনের মাথায় ব্যাপকহারে মারা যাচ্ছে আলু গাছ। এভাবে চলতে থাকলে ৯০ দিন পর জমিতে গাছই থাকবে না। ফলে আলু নিয়ে এবার চরম লোকসানে পড়তে হবে তাদের।
জানা গেছে, চলিতি মৌসুমের শুরুতে উন্নত জাতের আলু বীজের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয় জয়পুরহাটে ক্ষেতলাল এলাকায়। প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ায় ক্ষেতলালের কৃষকদের পছন্দ বিএডিসি’র আলু বীজ। এবার ৪০ কেজির প্রতি বস্তা বিএডিসি’র আলু বীজের সরকার নির্ধারিত দাম প্রকারভেদে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা। সঙ্কটের কারণে সেই বীজ কৃষকদের কিনতে হয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে। এবার টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সারের দামও অনেক বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে কৃষকদের। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে বেশি। কৃষকরা জানিয়েছেন প্রতিবিঘা জমিতে এবার তাদের খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। কিন্তু বীজ রোপনের প্রায় এক মাস পর থেকে আলু ক্ষেতেই গাছ মারা যাচ্ছে। প্রতি সাত দিন পর পর তারা জমি থেকে মরা গাছগুলো অপসারণ করছেন। কিন্তু ৬০ দিন বয়সে এসে জমিতে মড়কের ব্যাপকতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অথচ ৯০ দিন পর গাছ পরিপক্ক হবে। কৃষকদের অভিযোগ,আলু গাছের এ মড়ক শুধু বিএডিসি’র সরবরাহকৃত আস্টেরিক জাতের আলু খেতেই দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি ভাবে সরবরাহ করা অন্যান্য কোম্পানির আলু বীজের গাছ জমিতে ভাল আছে। আলুর জন্য এবার আবহাওয়াও অনুকুল। তারপরও প্রতিদিন জমিতে শুধু বিএডিসির আলু ক্ষেতের বড় বড় গাছ মারা যাচ্ছে। গাছ বাঁচাতে জমিতে একাধিকবার ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কোন সুফল মেলেনি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ৯০ দিন পর জমি থেকে তাদের কাঙ্খিত ফলন আসবে না। ফলে চরম লোকসানে পড়তে হবে এলাকার কৃষকদের । সরেজমিনে ক্ষেতলালের মুন্দাইল মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, বিঘার পর বিঘা সবুজে ঢেকে আছে বিস্তীর্ণ আলু ক্ষেত। দূর থেকে সবুজে আচ্ছাদিত মনে হলেও প্রতিটি ক্ষেতের ভিতরে দেখা গেছে বড় বড় আলু গাছ মরে গেছে। কয়েকজন কৃষককে দেখা গেছে তাদের খেতের মরা আলুগাছ অপসারণ করতে। কথা বললে কৃষকরা জানান, বেশ কিছুদিন থেকে তাদের আলু খেতের বড় বড় গাছ মারা যাচ্ছে। সাত দিন পর পর তারা গাছগুলো অপসরাণ করছেন। একাধিক বার ছত্রাক নাশকও প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু সুফল মিলছে না। শুধু মুন্দাইল নয়, এমন চিত্র ক্ষেতলালের শাখারুঞ্জ, ভাশিলা, মালিপাড়া ও জালিয়াপাড়া সহ অন্যান্য মাঠেরও। মুন্দাইল গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, স্থানীয় ইটাখোলা বাজারের বিএডিসি’র ডিলার মাসুদ রানার মাধ্যমে তাদের গ্রামের ৩০ জন কৃষক ঠাকুরগাঁও বিএডিসির সরবরাহ করা এ্যাস্টেরিক জাতের আলু বীজ কিনে ১০০ বিঘা জমিতে রোপন করেন। এর মধ্যে তার নিজেরই ১০ বিঘা।
এতে প্রতি বস্তা (৪০ কেজি) বীজের দাম পড়েছে ২ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু ৩০ দিন বয়স থেকে তাদের সবগুলো খেতেই আলু গাছ মরা শুরু হয়েছে। বর্তমানে তাদের ৬০দিন বয়সের আলু গাছ ব্যাপক ভাবে মরছে। মড়ক দেখে জমিতে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। একই গ্রামের দরিদ্র কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, অনেক পরিশ্রম করে তিন বিঘা জমি ইজারা নিয়ে বিএডিসি’র অ্যাস্টেরিক জাতের আলু তিনি রোপন করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। তিন মাস পর ক্ষেত থেকে তার আলু তোলার কথা। কিন্তু ৬০ দিনের মাথায় যেভাবে আলু গাছ মারা যাওয়া শুরু হয়েছে তাতে ফলন নিয়ে চরম শঙ্কায় দিন কাটছে তার। ইটাখোলার কৃষক রামীম কাজী বলেন, তার দেড় বিঘা জমিরও একই অবস্থা। বটতলী এলাকার কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, তার আড়াইবিঘা জমিতে রোপন করা বিএডিসি’র এ্য্যাস্টেরিক জাতের আলু গাছে ব্যাপক হারে মড়ক দেখা দিয়েছে। ছত্রাকনাশক দিয়েও এই মড়ক বন্ধ হচ্ছে না। বিএডিসি’র বীজের আলু গাছ মারা যাওয়ার এমন অভিযোগ ক্ষেতলালের শত শত কৃষককের।
ক্ষেতলাল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বিএডিসি’র আলু গাছ মারা যাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন,‘এবার বীজের তীব্র সঙ্কটের সুযোগ নিয়েছে কিছু অসাধু বীজ ব্যবসায়ী। বিএডিসি থেকে এবার চাহিদার সামান্য বীজ পাওয়া গেলেও অন্য জেলা থেকে বিএডিসির নাম করে নিম্নমানের অনেক বীজ বাজারে বিক্রি হয়েছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিএডিসির উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বিএডিসি’র বীজ বিপনন বিভাগের জয়পুরহাট ও বগুড়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোহা.শহিদুল্লাহ আল-মামুন মোবাইল ফোনে বলেন, বিএডিসির বীজে চাষ করা আলু ক্ষেতে এবার ঢলে পড়া (ব্যাকটেরিয়াল উইল্ড) রোগ দেখা দেওয়ায় গাছ মরে যাচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্ষেত পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে যেন আগামীতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। জেলায় এবার আলু চাষ হয়েছে ৪০ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে। বিএডিসি কর্তৃপক্ষ জেলায় এবার প্রায় ১৪ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে আলু বীজ সরবরাহ করেন মাত্র ২ হাজার টন। কিন্তু চাহিদার কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা কয়েক হাজার টন বিএডিসির আলুবীজ বিক্রি হয় ক্ষেতলালে।
সানশাইন/০৬ ফেব্রুয়ারি/ রোজি