• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১২ পূর্বাহ্ন

রাবি শিক্ষকদের হাত ধরে ঐতিহ্য ফিরে পেল ‘ঢাকাই মসলিন’

Reporter Name / ৪৩২ Time View
Update : শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকের নেতৃত্বে ১৭০ বছর পর ঐতিহ্য ফিরে পেল ঢাকাই মসলিন। ঢাকায় মসলিন এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি। একমাস আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে মসলিনের নতুন যুগে।

মসলিন ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক ধরনের মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়ে তৈরি হতো মসলিন। দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এই মসলিন ১৭০ বছর পর আবার ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন একদল গবেষক। দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৫০ সালে লন্ডনে প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে বোনা হয়েছে ঐতিহ্যবাহি মসলিন শাড়ি। গবেষকরা ছয় বছর চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামের প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হাতে নেওয়া হয়েছিল। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। ৬ বছরের প্রচেষ্টায় ধরা দেওয়া সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেন।

তিনি বলেন, বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’-এর কথা জানতে পারি। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এই গাছ চাষ হতো। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই হয়তো কোন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো মসলিন কাপড়, ফুটি কার্পাস কোনটাই ছিল না। ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে খোঁজখবর নিয়েছি। এরমধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেখে গাজীপুরের কাপাশিয়া থেকে একজন ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, কাপাশিয়ায় এই তুলার চাষ হতো। গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসাতে চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলা গাছ পাই। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলা গাছের সন্ধান পাই। সংগ্রহ করা এসব গাছ রাবির গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করি। স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খোঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আট টুকরা কাপড়ও সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর কোনটি মসলিন ছিলো না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়।

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন বলেন, কাপাশিয়া থেকে সংগ্রহ থেকে করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা ছিল। তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০-৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে ৬ জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে হাজির হলাম। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পেলাম। কিন্তু এতো মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিল না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করে। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বরাদ্দের ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের আরেকজন গবেষক অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের ৫টি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারা আশা করছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খুব শিগগিরই দেশে মসলিনের ব্যাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।

আরবিসি/০৬ ফেব্রুয়ারি/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category