• বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ পূর্বাহ্ন

অনলাইন ক্লাসে কতটুকু লাভ, কতটুকু ক্ষতি

Reporter Name / ২১৫ Time View
Update : শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

আবিসি ডেস্ক : ক্লাস বন্ধ। সারাক্ষণ মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে চোখ রেখে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। এটি মা-বাবার জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে লেখাপড়া কতটুকু হয়, তা বিচার করার চেয়ে এখন তাদের এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা ভেবে দেখা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক ক্লাস করার নাম নিয়ে সারা দিন তারা অনলাইন ঘাঁটছে, কোনো বাধানিষেধ কাজ করছে না।

অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং বিভিন্ন পর্যালোচনা বলছে, এই শিশুশিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বজনদের বিচ্ছিন্নতাও বাড়ছে। সমস্যা নিয়ে মতবিনিময় কমে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা দেখছেন, এদের অনেকেই কঠিন মানসিক ও শারীরিক অবসাদে ভুগছে। উদ্বিগ্ন থাকছে। এমনকি পড়াশোনায় একাগ্র মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। অনেকের কাছে আবার অনলাইনে ক্লাস করাটা ভীতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভীতিকর উৎসের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের মানসিক সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তাদের স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, তারা হয়ে পড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত।

অবস্থাদৃষ্টে এই ই-শিক্ষাব্যবস্থা বৈষম্যমূলক, কারণ এতে অধিকাংশের প্রবেশাধিকার নেই। একঘেয়ে ও অবসাদ সৃষ্টিকারী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অত্যধিক মানসিক ও শারীরিক চাপ আর অবসাদ সৃষ্টি করছে, যা শিশুশিক্ষার মূল প্রকৃতি, প্রেষণা ও উদ্যোগকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে। এ শিক্ষা কি আমাদের প্রজন্মকে সহায়তা করছে নতুন কিছুকে জানতে? আগ্রহ, অনুপ্রেরণা ও চেতনা বৃদ্ধি করতে? শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে আনন্দ ও ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার যথাযথ কর্মময় সম্পর্ক তৈরি করতে?

যদি অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তাহলে আমার বাকি কথাগুলো মূল্যহীন।
আর যদি তা না করে থাকে, তাহলে ই-শিক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখাটা কার জন্য? কার উপকারে? বিদ্যালয়গামী অল্পবয়স্কদের জন্য এ নিয়মে ই-শিক্ষা গ্রহণ যদি কার্যকর না হয়, বরং তা মানসিক ও শিখন-সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে, তবে তা চালু রেখে লাভ কার? আমি হয়তো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাপ্রসূত মতামত প্রদান করছি না। তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কি যথেষ্ট সময় হয়নি এ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পরিস্থিতি জানার ও জানানোর? ই-শিক্ষা মা-বাবার জন্য কি দিচ্ছে? প্রথমত, প্রযুক্তি সুবিধাবঞ্চিত মা-বাবাকে দিচ্ছে না পাওয়ার ও সব হারানোর হতাশা?

দ্বিতীয়ত, মা-বাবা, যাঁরা সন্তানকে প্রযুক্তি সহায়তা দিতে পারেন, মূলত শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অধিক সময় দিয়ে সহযোগিতা ও প্রেষণা দানের চেষ্টা করছেন। যদিও চাকরিজীবী মা-বাবার জন্য যা একটি বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যেহেতু ‘বাড়ি থেকে অফিস’ এ কারণে প্রায় অফিসেরই মিটিংয়ের সময়সীমা পর্যুদস্ত, রাতবিরেত বলে সময়সীমা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, এতে করে তাঁদের অফিস ও পারিবারিক সম্পর্কের ভারসাম্য বিরাট বিপর্যয়ের মুখে। অনেকে এ কারণেও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন (কোভিড-করণীয় অন্যান্য ছাঁটাই তো আছেই)। সর্বোপরি এই অকালবয়স্ক শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে সাইবার সেক্সুয়াল অপরাধের দিকে, যাতে অনেকে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে।

বাবা-মায়েরা অবশ্যই সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন বিষয়টি সামলে নিতে। তবে সব মা-বাবা যদি সন্তানের বিদ্যালয়মুখী (প্রচলিত) শিক্ষা প্রদানে সক্ষমই হতেন, তাহলে তো জগতে রাষ্ট্রীয় শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনই হতো না। মা-বাবার দুশ্চিন্তা, মনো-সামাজিক বৈকল্য, অপারগতার যন্ত্রণা, নিজেকে অযোগ্য মনে করে প্রতিনিয়তই দুর্বিষহ যন্ত্রণায় থাকা, উন্নতমানের প্রযুক্তি সরবরাহের চাপ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

না হয় বাদ দিলাম ঘরের অপর্যাপ্ত পরিসর, লোকসংখ্যা, শিশু, অসুস্থ ও বয়স্কের স্বাস্থ্য ও পছন্দ-অপছন্দের পরিচর্যা প্রভৃতি সুনসান নীরব ‘সবকিছু ঠিকঠাক’ এমন একটি পরিবেশ ঘরে পাওয়া, বিশেষ করে যেখানে বাড়িতে একের অধিক শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও অন্যান্য সদস্যও রয়েছেন।

উল্লিখিত একেকটা বিষয়ই পরিবারে শারীরিক ও মানসিক অশান্তি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। সেখানে শুধু কল্পনা করুন দীর্ঘকালীন সবগুলোর জটিল সমন্বয় একটি পরিবারে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে!

তাহলে সমাধান কী? গৃহালয়কে বিদ্যানিকেতনে পরিণত করা। এই ই-শিক্ষা বন্ধ করে এ মুহূর্তে এক বছর (বা যত দিন লাগে) স্বাভাবিক সময়ে শিক্ষালয়গামী শিশু ও তরুণেরা যদি ঘরে সংসারের সাধারণ কাজগুলো শেখে, তা তার জীবন রক্ষকারী দক্ষতা তৈরি করবে, সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্যের অন্বেষণ ঘটাবে, বাড়ির ছোটবড় ও সেবা-সহকারীদের সঙ্গে মত ও কাজ বিনিময়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবে, সর্বোপরি পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্মানজনক সম্পর্ক তৈরিতে সহায়ক হবে, যা অবশ্যই পরিবার ও ব্যক্তিপর্যায়ে দৃঢ় মানসিক ও নৈতিক ভিত তৈরি করবে, যা আজকের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অচেনা বিষয় বলে পরিগণিত হচ্ছে।

শিক্ষাবর্ষ শেষে শিক্ষালয়ের দায়িত্ব হবে এই বাড়ি-নিমগ্ন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মূল্যায়ন করা। এই বছরের জন্য এটাই হোক পাঠ্যক্রম। এই পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য বিশাল বাজেটের বিশেষজ্ঞ ভাড়া করতে হবে না, মোটামুটি একটি নির্দেশিকা দরকার, দক্ষতাগুলো কোন মান পাবে, তা নির্ণয়ের জন্য। দক্ষতাগুলোর উদাহরণ হতে পারে, কোনো কাজকে ছোট মনে না করা, কাজের মূল্যায়নে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, দলীয় আনন্দ ও সাফল্য নির্ধারণ করা, বিনয়, জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ভাঙার সৎসাহস, ধৈর্যধারণ, স্বল্পে তৃপ্তি, সীমিত সুযোগ পাওয়া শিশু ও অন্যদের প্রতি সমমর্মিতা প্রভৃতি।

এর সঙ্গে যোগ করতে হবে সব টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েকবার ১-২ ঘণ্টাব্যাপী পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে মনোসামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করে মানসিক স্বাস্থ্য ও নৈতিকতা জোরদার করে তোলা।

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিশু, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও অন্যদের ওপর অপশক্তির প্রকাশ্য সহিংসতার যে তাণ্ডবলীলা চলছে, তা সমষ্টিগতভাবে বিচার, আইন, নারীশিক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একযোগে সবাই মিলে কর্মক্ষম সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা ও সহিংসতানিরোধক সুব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করলেও তা বিশেষ কার্যকর ও স্থায়ী হবে না, যদি আমরা এর প্রতিকারে ‘ঘরে ঘরে মূল্যবোধের পারিবারিক দুর্গ’ গড়ে তুলতে না পারি।

শীপা হাফিজা সমতা ও মানবাধিকার কর্মী এবং সমাজ বিশ্লেষক

আরবিসি/০৫ ফেব্রুয়ারী/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category