আরবিসি ডেস্ক : দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নিঃসন্দেহে প্রভাব পড়েছে। তারা যে হাসি-আনন্দে ক্লাস করতো, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠতো তার কিছুই সম্ভব হয়নি এই করোনাকালে। শিক্ষাজীবনের আরেকটি বড় আনন্দ পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া। পরীক্ষা যদিও কিছুটা ভীতিকর ব্যাপার, তার মধ্যেও বিশাল এক আনন্দ লুকিয়ে থাকে, যার প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটে। পাবলিক পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে, লাফিয়ে যখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে; এবং সেটি যখন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয় তখন সেই আনন্দ উপলব্ধি করা যায়।
অথচ ক্লাস এমনকি পরীক্ষা- দুটো আনন্দ থেকেই আমাদের শিক্ষার্থীরা এবার পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। পরিবেশ পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাদের সেগুলো মেনে নিতে। ফলে কর্তৃপক্ষও বাধ্য হয়েছেন বিকল্প খুঁজতে। না হলে তাদের শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হতো। যে কারণে এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এখানে আসলে করার কিছু ছিল না প্রকৃতঅর্থে। অথচ বিষয়টি অনুধাবন না করে অনেকে শিক্ষার্থীদের ‘পরীক্ষা ছাড়াই পাস’, ‘পড়াশোনা না করেই পাস’, ‘সবাই পাস’, ‘গণপাস’, ‘অটোপাস’ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। এ ধরনের মন্তব্য শিক্ষার্থীদের মনে কুঠার দিয়ে আঘাত করার মতো- সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনও?
করোনাসৃষ্ট মহামারির কারণে অনলাইনে বা টেলিভিশনে বিকল্প শিক্ষাদানের চেষ্টা হলেও আমাদের দেশে বিষয়টি খুব বেশি সাফল্য বয়ে আনেনি। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে সবকিছু সমন্বয় করে কাজটি করা সহজ নয়। তবে, সরকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এ-কথাও মানতে হবে, স্কুলের সার্বিক পরিবেশে অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মেশা ও শেখা, এবং তার পরিবর্তে বাসায় পড়ানোর চেষ্টা ভিন্নতর ফল বয়ে আনতে বাধ্য। কেননা দুটো বিষয় এক নয়। ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একযোগে পড়ার মাধ্যমে যে শিক্ষণ প্রক্রিয়া সেটি না-থাকায় এ বছর যা যা শেখা উচিত তার অনেকখানিই হয়নি- এটি বাস্তবতা। একে আমরা অস্বীকার করতে পারবো না।
পড়াশোনা ও পরীক্ষার পাশাপাশি কো-কারিকুলাম কার্যক্রম যেগুলো থাকে সেগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে গত বছর। অনলাইনে তারা হয়তো সিলেবাস শেষ করছে, কিন্তু সেটা করছে বেছে বেছে। ফলে একটা পাঠের সঙ্গে আরেকটার যে লিংক- শিশুরা সেটি ধরতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেছিলেন- করোনার মধ্যে কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে তা অনিশ্চিত। তবে অক্টোবর ও নভেম্বরে স্কুল খোলা যতে পারে। সেটির প্রস্তুতি নিয়ে দুটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, যে মাসে স্কুল খোলা যাবে সেই সিলেবাসের আলোকে মূল্যায়নের মাধ্যমে পরবর্তী ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উন্নীত করা হবে। আর স্কুল খোলা না-গেলে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না। তখন আটোপাস ছাড়া উপায় থাকবে না।
এভাবে ক্লাস, পরীক্ষা না-হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়েও একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করে অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অনলাইনে অপর্যাপ্ত শিক্ষাদান, শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া না থাকা, সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পাঠ কার্যক্রম পরিপূর্ণ শেষ না হওয়ার জের ধরে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই একটি বড় ঘাটতি থেকে গেছে। এই ঘাটতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে ২০২১ সালে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর চ্যালেঞ্জ। সুতরাং ‘তোমরা অটোপাস করেছ!’- এভাবে না বলে আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। কারণ পরিস্থিতি এখনও আমাদের অনুকূলে নেই। স্বাস্থ্যঝুঁকিই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। যে কারণে জানুয়ারি চলে গেলেও এখনও এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হয়নি। এমনকি শিক্ষকগণ বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছেন না। এটি নিঃসন্দেহে শিক্ষার একটি ভয়ঙ্কর চিত্র। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ভর্তির সময় টাকা নেওয়া হয় না, সেখানেও ভর্তির হার ব্যাপকভাবে কমেছে। তাহলে এই সময় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তা কতটা যুক্তিযুক্ত হতো বা সাড়া পাওয়া যেত?
এখন যেভাবে ফল প্রকাশ করা হয়েছে এটি বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতেই করা। গত ৭ অক্টোবর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কী পদ্ধতিতে গ্রেড নির্ধারণ করা হবে সেটি নির্ধারণ ও পরামর্শের জন্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, শিক্ষা বোর্ড ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হবে। তাদের আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন দিতে বলা হবে। তার ভিত্তিতে ডিসেম্বরে এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে।’
এরপর ২৫ নভেম্বর আয়োজিত আরেক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এইচএসসির ফল নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। জেএসসি ও এসএসসি রেজাল্ট নিয়েই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। তবে এসএসসির ফল ৭৫ শতাংশ ও জেএসসির ২৫ শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হবে।’
বিশেষজ্ঞরা এভাবেই মত দিয়েছেন। এবং তার আলোকেই ডিসেম্বরে এইচএসসির ফল প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে সম্ভব হয়নি। আইনি জটিলতা নিরসনে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ করতে ২৪ জানুয়ারি আইন পাস করে জাতীয় সংসদ। সংসদে শিক্ষামন্ত্রী ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন (অ্যমেন্ডমেন্ট) বিল-২০২১সহ তিনটি বিল পাসের জন্য উত্থাপন করেন। পরে সেগুলো কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। সুতরাং এ বিষয়ে আর কোনো দ্বিধা রাখা উচিত নয়। এ নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা করতে পারি কিন্তু এর বিকল্প আমাদের হাতে ছিল না। তাই মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছে।
এই পরিবর্তীত পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রেণিকক্ষের মুল্যায়ন, অবিরত মূল্যায়ন বিষয়টি জরুরি। সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মুল্যায়ন হয় না। আমাদের শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুরো ব্যবস্থা ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যাতে পরীক্ষা নেওয়া হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা বহুদিন বইয়ের সঙ্গে, প্রকৃত লেখাপড়ার সঙ্গে সংযুক্ত নেই। তাদের আমরা কোনোভাবেই দায়ী করতে পারি না। পরীক্ষা দিয়ে ফল অর্জন করার মধ্যে যে আনন্দ সেই আনন্দ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছে। তার ওপর যদি শিক্ষার্থীদের মনে আমরা আঘাত দিয়ে কথা বলি সেটি তাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার হবে। মনে রাখতে হবে, এটি শিশু আইনেরও পরিপন্থী।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
আরবিসি/০৪ ফেব্রুয়ারী/ রোজি